২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

হকারে বেহাল ঢাকার ফুটপাথ

-

মানুষ হাঁটতে পারে না, গাড়ি চলতে পারে না। কিছু সড়ক বাদে প্রায় সব ফুটপাথেই দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসেছে, আর ক্রেতারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দরদাম করছে। ফুটপাথজুড়ে দোকান আর দোকান। শহরের কোনো কোনো অংশে রাস্তা আছে বলেই মনে হয় না। রাস্তার পুরোটাই বাজার। রাস্তার পাশে মার্কেটে যারা অনেক টাকা খরচ করে স্থায়ী দোকান দিয়েছেন, তারা আছেন সবচেয়ে বিপাকে। তাদের দোকানের সামনের ভাগ দখল, কিছু বলার মতা নেই। কারণ এরা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন পায়। এই হলো রাজধানী ঢাকার ফুটপাথের অবস্থা। ঢাকার ফুটপাথের বর্তমান পেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন সুমনা শারমিন

ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে রাজধানীর ফুটপাথ দখলে রাখা হকাররা। এতে কিছুতেই মুক্ত করা যাচ্ছে না রাজধানীর বেশির ভাগ ফুটপাথ। হকারদের দাপটের কাছে দৃশ্যত অসহায় হয়ে পড়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। হকারদের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। ফলে মেয়রের নির্দেশ উপো করে ফুটপাথের পাশাপাশি রাস্তাও দখল করে রেখেছে হকাররা। এতে ব্যাহত হচ্ছে নগরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। অনেক সময় প্রতিবাদ করতে গেলে হকারদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন পথচারীরা। হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে অহরহ। কিন্তু হকার উচ্ছেদ হচ্ছে না কিছুতেই। সরজমিন দেখা গেছে রাজধানীর বেশির ভাগ ফুটপাথ দীর্ঘ দিন থেকে হকাররা দখল করে ব্যবসায় করে আসছে। অনেক স্থানে স্থায়ী মার্কেট বানিয়ে ফেলেছে তারা। বিশেষ করে গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট এলাকা, বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকা, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, দৈনিক বাংলার মোড়, মালিবাগ, মতিঝিল, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী এলাকা এর মধ্যে অন্যতম। এসব স্থানে ফুটপাথের পাশাপাশি রাস্তাও দখল করে রেখেছে হকাররা। ফুটপাথের দোকান থেকে অল্প দামে জিনিসপত্র কিনতে পারলেও চলাচলে ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। এ কারণে ব্যাপক ুব্ধ নগরবাসী। বিভিন্ন সময় তারা ফুটপাথ থেকে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবির কারণে সিটি করপোরেশন থেকে বারবার হকার উচ্ছেদে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও প্রতিবারই সকালে উচ্ছেদ করলে বিকেলে দোকানপাট নিয়ে বসে যায় হকাররা। অনেক সময় সকাল-বিকেল দুবার উচ্ছেদ অভিযান চালালেও আবার পরণে দোকান নিয়ে বসে পড়ে তারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, হকাররা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতাদের কর্মী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকেন নেতারা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে মিছিলে হকারদের নিয়ে যান। এ ছাড়া সরকারি রাস্তা ও ফুটপাথে ব্যবসায় করলেও এসব হকারের কাছ থেকে সরকারি দলের নেতারা চাঁদাবাজি করেন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা লাইনম্যানদের মাধ্যমে চলে যায় তাদের কাছে। মাস শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকা। এ টাকার অংশ সিটি করপোরেশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন দফতরেও যায় বলে প্রচার আছে। ফলে মেয়রসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও হকার মুক্ত হচ্ছে না ফুটপাথ-রাস্তাঘাট।
বিকেল ৪টার আগে ফুটপাথে হকার না বসার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু সেই নির্দেশ লঙ্ঘন হয়েছে বহু আগে। সুযোগ পেলেই হকার বসছে ফুটপাথ এবং কোথাও কোথাও ফুটপাথ ছাড়িয়ে রাস্তায়।
ফুটপাথ ধরে মানুষের হাঁটা দূরে থাক, কোনো কোনো এলাকায় ফুটপাথে মানুষ ঢুুকতেই পারছে না। লাইনম্যান, স্থানীয় মাস্তান, প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা ও কিছু পুলিশ সদস্য এসব হকার বসিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কোনো কোনো বাড়ির সামনে বাড়ির মালিকই হকার বসিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) পরিসংখ্যান মতে, নগরীর ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাথ রয়েছে। এর মধ্যে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাথই এখন অবৈধ দখলে। আর ২২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার রয়েছে বেদখল। এগুলোতে সরকার দলের অঙ্গসংগঠনে নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় বসেছে পণ্যের পসরা। কোথাও কোথাও ফুটপাথ ছাড়িয়ে মূল সড়ক পর্যন্ত বসছে পণ্যের পসরা। ফলে নগরীতে পথচারীদের ভোগান্তি আর সড়কের যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ঢাকা সিটি ম্যানুয়াল-১৯৮২ ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-তে রাজধানীর ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত রাখতে বলা হয়েছে। একই সাথে ফুটপাথ পথচারীদের হাঁটার জন্য উপযোগী করার কথাও উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ১৫ নম্বর ধারায় পুলিশের সাধারণ দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, জনগণের জন্য অস্বস্তিকর ও তিকর অবস্থার অবসান ঘটানোর দায়িত্ব পুলিশের। ফুটপাথ থাকবে পথচারীদের নির্বিঘেœ হাঁটার উপযোগী পরিবেশ। ফলে ফুটপাথ দখল করে দোকান দিয়ে পথচারীদের হাঁটা-চলায় বাধা সৃষ্টি করলে তা সমাধানের দায়িত্ব পুলিশের।
বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার সমিতির তথ্য অনুসারে বর্তমানে ঢাকা শহরে এক লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি হকার রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার স্থায়ী এবং ৬০ হাজার অস্থায়ী।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহায়সম্বলহীন একদল মানুষ প্রতিনিয়ত ঢাকা শহরে এসে কাজের সন্ধানে হকার পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। সামান্য পুঁজিতে ফুটপাথে বসে যেকোনো ধরনের ছোটখাটো ব্যবসায় করা যায়। ওই দিয়েই একেকজনের আয়ে তিন-চারজনের একটি সংসার চলে। প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাসের এই নগরী আসলে এক বিশাল বাজার। এই বাজারে অন্তত ২৫ শতাংশ অর্থনীতি পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হয় এই হকারদের মাধ্যমে। হকারদের কাছ থেকে সস্তায় জিনিসপত্র কেনা যায়। ফলে এই উচ্চমূল্যের বাজারে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্তের লোকজন কেনাকাটার জন্য হকারদের ওপর নির্ভরশীল। এই কারণে হকারদের উচ্ছেদের ব্যাপারটি আসলে একপাকি কোনো ব্যাপার না। তাদের উচ্ছেদ করলে কোথায় গিয়ে তারা দাঁড়াবে, এই বিষয়টি ও অবশ্যই ভাবতে হবে। এ ছাড়া যানজট সৃষ্টির জন্য হকারদের দায়ী করা হলেও তারা আসলে এ জন্য কতটা দায়ী সেটিও ভেবে দেখতে হবে। তবে হকাররা স্র্রোতের মতো আসতে থাকবে আর ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাবে-দিনের পর দিন এ অবস্থায়ও চলতে পারে না।
ছবি : জাকির হোসেন চৌধুরী


আরো সংবাদ



premium cement